দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে ব্যবসা করার জন্য ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, বিএনপি সরকারের সময় হাওয়া ভবনের দৌরাত্ম্যের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের স্মরণ আছে। আগে তো অপনাদের লাভের একটা বড় অংশ হাওয়া হয়ে যেত। এখন আর হাওয়া হওয়ার সুযোগ নেই।
সেখান থেকে সবাইকে মুক্ত রেখেছি। সেটাই মাথায় রেখে যদি মনে করেন (ব্যবসা করেন) যে, না, দেশের কথা ভাবতে কবে, মানুষের কথা ভাবতে হবে। বুধবার সরকারি বাসভবন গণভবনে দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে কোনো হাওয়া ভবন নেই, আর পিএমওতে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে) কোনো উন্নয়ন উইংও নেই। যে হাওয়া ভবনে একভাগ দিতে হবে, উন্নয়ন ভবনে একভাগ দিতে হবে বা অমুক জায়গায় দিতে হবে। এই যন্ত্রণা তো আপনাদের ভুগতে হয় না এখন আর। এটা তো আপনারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন। সেই যন্ত্রণা থেকে তো সবাই মুক্ত।’ তিনি বলেন, ২০০৯-এ সরকার গঠনের পর আমাদের ব্যবসায়ীরা, সে যে দলেরই হোক, আমরা কিন্তু ওখানে দল বাছতে যাইনি। যে দলেরই হোক যাতে তারা ব্যবসাটা ব্যবসায়ী হিসাবে করতে পারেন, সেই পরিবেশটা সৃষ্টি করে দিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৪ বছর ধারাবাহিকভাবে আপনারা লাভজনক ব্যবসা করে গেছেন। আমরা কিন্তু করোনার সময়ও সেটা মোকাবিলা করলাম। প্রণোদনা দিলাম, বিশেষ প্রণোদনা। আমার কাছে কেউ এসে দাবি করেননি। কেউ বলেননি। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার একটা টিম খুব ভালো কাজ করছিল-কোথায় কী করা যেতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অবরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ, তাদের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ। আমরা বলেছি, এগুলো বন্ধ হতে দেব না। চালু রাখতে হবে। শ্রমিকদের বেতন, এই যে গার্মেন্ট, তার বেতন তো আমি দিয়ে দিলাম সব। প্রণোদনা প্যাকেজ করলাম, বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন বিরোধী দল একটু মাঠে নামায় ব্যবসায়ী মহলে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে অথবা কারও কারও মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে, যদি আবার হাওয়া ভবন খুলতে পারে তাহলে কী সুবিধা পাবেন জানি না। কেন হঠাৎ দেখি একেকটা সুর তোলে-এটা নেই, ওটা নেই, এটা হবে না, ওটা হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো আমরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। যেখানে ইংল্যান্ডে ৪০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে। আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। তার ওপর বিশ্বব্যাপী গ্যাসের সমস্যা চলছে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সম্ভবত প্রথমবারের মতো মজুত থেকে তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। যুক্তরাজ্য বিদ্যুতের দাম ৮০ শতাংশ বাড়িয়েছে এবং সমগ্র ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যসহ শীতপ্রবণ দেশগুলোকে শক্তি সঞ্চয়ে শীতকালীন পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে।’ জ্বালানি ক্ষেত্রে ব্যাপক ভর্তুকি প্রদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এলএনজি কিনে এনে ব্যবসায়ীদের সাপ্লাই দিচ্ছি। যে টাকা দিয়ে আমরা কিনছি, যে খরচ পড়ছে, তার চেয়ে কম টাকায় আমরা দিচ্ছি। যেখানে ৬০ টাকা পড়বে প্রতি লিটার, সেখানে আমরা ৯ টাকা প্রতি লিটারেও সবাইকে এলএনজি সাপ্লাই দিয়েছি।
কিন্তু সমস্যাটা বাংলাদেশে নয়, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। সেটা মাথায় রাখতে হবে। যেসব জায়গা থেকে আমরা সার, গম বা খাদ্যপণ্য আনি, আজ সব জায়গায় সমস্যা।’
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস সম্পর্কে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ সময়কালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। কারণ অবৈধ হুন্ডি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে বেশির ভাগ রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হয়েছিল এবং রিজার্ভ থেকে ব্যয়ও সেই সময়ে কম হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমদানি শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করা হয়েছে এবং এগুলো কাজ শুরু করলে অবশ্যই রিটার্ন পাওয়া যাবে।’
মতবিনিময়কালে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দুর্ভিক্ষ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, আমি কেন বলছি (আসন্ন দুর্ভিক্ষের কথা) এবং কীসের ভিত্তিতে। এটি আমার একটি উপলব্ধি, যা দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে আসা।’
তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি, ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা আগেই বলেছি। এখন সব বিশ্বনেতা একই কথা বলছেন।’
ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঋষি সুনাকের প্রথম বক্তৃতায় উঠে আসা সংকট সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি (ঋষি) দেশবাসীর কাছে বারবার আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের (জনগণের) যেটুকু জমি আছে তাতে খাদ্য উৎপাদন করতে, যাতে দেশকে কখনোই কোনো খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হতে না হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া সর্বশেষ ভাষণ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি এবং বর্তমান বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টিকারী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য অর্থব্যয় না করে সেই অর্থ জনগণকে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। তিনি বলেন, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারব কি না, তা নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন,‘আমার কী হবে, তা আমি চিন্তা করি না। আমি যা সত্য তাই বলছি।’
তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বারবার অনুরোধের পরও প্রতিবেশী দেশ ভারতকে গ্যাস দিতে অস্বীকার করায় ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি।