সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ‘নিয়ম রক্ষা’ হিসেবে আগামী ৩০ অক্টোবর শুরু হতে যাচ্ছে চলমান একাদশ জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশন। তবে কয়েকটি কারণে অধিবেশনটি হতে পারে ঘটনাবহুল। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে এই অধিবেশন চলাকালে নতুন সংসদ উপনেতা নির্বাচন করা হতে পারে। রওশন এরশাদকে সরিয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করেও সংসদ উত্তপ্ত করতে পারেন জাপার সংসদ সদস্যরা। জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্পিকারের অনুমোদন দাবি করে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করতে পারেন জাপার এমপিরা। অন্যদিকে, ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ ২৮ অক্টোবর দেশে ফিরে ৩০ অক্টোবর সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদেও পরিবর্তন আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে আসন্ন অধিবেশনে। বর্তমান বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে দল থেকে বহিষ্কার করে এই পদে দলের অন্য এক সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন দিতে পারে জাপা। এসব ঘটনার বাইরে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি জোরদারের লক্ষ্যে বিএনপির সংসদ সদস্যদের সংসদ থেকে পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আসতে পারে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী গত ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করায় সংসদ উপনেতার পদটি খালি হয়েছে। সংসদ উপনেতার পদটি একজন পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ২০তম অধিবেশন চলাকালে নতুন একজনকে সংসদ উপনেতা করা হতে পারে। নতুন সংসদ উপনেতা হিসেবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে।
সংসদ উপনেতা হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো সময়ের মধ্যে কাউকে নিয়োগের বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতেও এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে সংসদ নেতার (প্রধানমন্ত্রী) অনুপস্থিতিতে সংসদে সরকারি দলের নেতৃত্বদানের জন্য সংসদ উপনেতার পদটি গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, আসন্ন অধিবেশনের আগে কিংবা অধিবেশন চলাকালে সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা ডাকা হতে পারে। সভায় নতুন সংসদ উপনেতা মনোনয়ন করা হলে এসংক্রান্ত ফাইল যাবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে। রাষ্ট্রপতি ফাইলে অনুমোদনের মাধ্যমে নতুন সংসদ উপনেতা নিয়োগ দেবেন। এরপর সংসদ সচিবালয় থেকে এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
বিরোধীদলীয় নেতা প্রশ্নে জাপার বিরোধ গড়াবে সংসদে :রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা থাকবেন, নাকি জি এম কাদের নতুন করে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন—এই ইস্যুতে জাপার চলমান অভ্যন্তরীণ সংকটের ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে সংসদে। ‘দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না’—এমন কারণ দেখিয়ে তার পরিবর্তে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে গত ১ সেপ্টেম্বর চিঠি দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। ওই দিন সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে দলটির ২৬ জন এমপির মধ্যে ২৩ জন জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়ন করে গৃহীত প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন।
স্পিকারকে দেওয়া জাপার ঐ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। কিন্তু আগের অবস্থান থেকে সরে রওশনের পক্ষ নেওয়ায় এবং স্পিকারকে দেওয়া চিঠির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাঙ্গাকে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদপদবি থেকে অব্যাহতি দেন জি এম কাদের। এরপর স্পিকারের সঙ্গে দেখা করে রাঙ্গা সেই চিঠি প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
এ ব্যাপারে জি এম কাদের বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হিসেবে উনি (রাঙ্গা) চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। এখানে ব্যক্তি কোনো বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে, চিঠিটা জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির, সিদ্ধান্তও পার্লামেন্টারি পার্টির। কাজেই, উনি (রাঙ্গা) সেই চিঠি প্রত্যাহারের অনুরোধ বা আবেদন করতে পারেন না। কেননা, সেটি তার কোনো ব্যক্তিগত কিংবা একার কোনো চিঠি নয়।’
চিঠির বিষয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে জাপা। তবে চিঠির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি স্পিকার। এ ব্যাপারে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘চিঠি পেয়েছি। চিঠি নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। চিঠিটা আমি পরীক্ষা করছি। সংশ্লিষ্ট আইন ও কার্যপ্রণালী বিধি পরীক্ষা করে দেখছি। এগুলো দেখা শেষ হলে আমি জানাব।’
প্রসঙ্গত, বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে দেশের সংবিধানে কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার স্পিকারের। সংসদের কর্যপ্রণালী বিধির ২(১)(ট)-তে বলা বলা হয়েছে, “‘বিরোধীদলীয় নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা”। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পরও বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া নিয়ে স্পিকারকে পালটাপালটি চিঠি দেন রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। শেষ পর্যন্ত দলের ভেতরে সমঝোতায় রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হন।
এর আগে ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে, জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার বিষয়ে পার্লামেন্টারি পার্টির চিঠি স্পিকার আমলে না নিলে সংসদের আসন্ন অধিবেশনে দলের এমপিরা ওয়াকআউট করবেন। এ ব্যাপারে বৈঠকে অলিখিত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও ইত্তেফাককে জানান দলটির একাধিক এমপি।
দল থেকে বহিষ্কার হচ্ছেন রাঙ্গা :মসিউর রহমান রাঙ্গাকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকেও বহিষ্কার করা হচ্ছে। গত ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জাপার প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘রাঙ্গার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদে থাকার প্রশ্নই আসে না।’ অন্যদিকে, রাঙ্গাকে ইতিমধ্যে রওশনের ডাকা আগামী ২৬ নভেম্বরের কাউন্সিলের প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে। জানা গেছে, জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম ও ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী—এই তিন জনের মধ্যে যে কোনো একজন নতুন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হতে পারেন।
বিএনপির এমপিদের পদত্যাগের আলোচনা :নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদারের লক্ষ্যে সংসদ থেকে বিএনপিদলীয় ছয় জন সংসদ সদস্যের পদত্যাগের আলোচনা শুরু হয়েছে দলটিতে। দলের সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠকে একমত হন যে, সরকারের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি, সেটিকে জোরদার করতে হলে আগে বিএনপির এমপিদের সংসদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জানা গেছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ শেষে দলীয় এমপিদের পদত্যাগের বিষয়টি আরো জোরদার হতে পারে। এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পদত্যাগের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে সবাই জানতে পারবে।
আরও পড়ুন: সুইসাইড নোটসহ অভিনেত্রীর লাশ উদ্ধার