বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ১০:২৬ পূর্বাহ্ন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের তিনটি বিকল্প ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ১৯ বার পঠিত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আপাতত তিনটি বিকল্প নিয়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ নির্বাচন অথবা বিএনপি ছাড়া নির্বাচন—এই দুই বাস্তবতা মাথায় রেখেই বিকল্পগুলো ভাবা হয়েছে বলে জানান দলের কয়েকজন নীতিনির্ধারক।আরো পড়ুন: কালশী উড়ালসেতু উদ্বোধন কালদলীয় সূত্র জানায়, যা কিছুই করা হোক আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য থাকবে এবারের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখিয়ে বা রেখে জয়লাভ করা। মূলত তা নিশ্চিত করতেই একাধিক বিকল্প নিয়ে কাজে হাত দিয়েছে দলটি। কারণ এবার সব মহল থেকেই অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের চাপ আছে।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা কালের কণ্ঠ’র কাছে তিন ধরনের বিকল্পের কথা বলেছেন। প্রথমত, বিএনপি নির্বাচনে এলে কিভাবে জয়লাভ করা যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি নির্বাচনে না এলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সামর্থ্য অনুসারে সর্বোচ্চ আসনে প্রার্থী দিতে উৎসাহ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত, অনিবন্ধিত সব দলকেই নির্বাচনে রাখার কৌশল নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদেরও নিজ দলের প্রতীকে সারা দেশে প্রার্থী দেওয়ায় উৎসাহিত করা হবে।তৃতীয়ত, বিএনপিসহ একাধিক দল যদি একেবারে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তুতি রাখা হবে। প্রতিটি আসনে এখন থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী ঠিক করে রাখার নির্দেশনাও দিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি এমনকি বিএনপির সাবেক এমপিদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।এসব তৎপরতার অন্যতম লক্ষ্য হলো—বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা আটকানো। বিএনপি নির্বাচনে না এলে ৩০০ আসনের কোথাও যেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হতে না পারেন সে লক্ষ্যে একাধিক বিকল্প নিয়ে এখনই কাজ শুরু করা হয়েছে।

২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি জোট ও সমমনা দলগুলো বর্জন করায় অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র দলগুলোর প্রার্থীরা। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা সমালোচনায় পড়তে হয় আওয়ামী লীগকে। বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া নির্বাচনীব্যবস্থা এবং গোটা নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এবার তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি।জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সংসদীয় উপনেতা মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে অন্য যে দলগুলো আছে তাদের নিয়ে নির্বাচন হবে। বিএনপি না এলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না, এটা গণতন্ত্রের কোনো বইয়ে লেখা নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতি একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কথা বারবার বলছেন। আমরা সে ধরনের একটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।মিত্র দলগুলোর সর্বোচ্চ প্রার্থী : বিএনপি আগামী নির্বাচনে না এলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল, জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অন্য মিত্র দলগুলোকে সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে প্রার্থী দেওয়ার জন্য বলবে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সম্ভাবনা বেশি। কয়েকটি আসন ছেড়ে দেওয়া হবে ১৪ দলের শরিকদের জন্য। যে আসনগুলো ছেড়ে দেওয়া হবে সেগুলোতে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকের কোনো প্রার্থী দেবে না। তবে আওয়ামী লীগের যেসব আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা যাবে সেখানে প্রার্থী দিতে বলা হবে মিত্র দলগুলোকে।

দলের আরেকটি সূত্রের মতে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, তরীকত ফেডারেশন মিলে দেশের ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারে।

বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেয়েছে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার দল তৃণমূল বিএনপি। এই দলের পক্ষ থেকেও দেশের বিভিন্ন আসনে প্রার্থী দেওয়া হতে পারে।

ইসলামী দলগুলোকে পক্ষে রাখার চেষ্টা : আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোকেও প্রার্থী দেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনও এ লক্ষ্যে একাধিক ইসলামী দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে আছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন এ দলটির সারা দেশে ভোট রয়েছে। ফলে এ দলটিকে আগামী নির্বাচনে সারা দেশে প্রার্থী দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেবে আওয়ামী লীগ।গত ২ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি সেখানে ইসলামের কল্যাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া নানা উদ্যোগের বিষয় তুলে ধরেন।দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, জাকের পার্টি এবং ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ এ দল দুটির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আওয়ামী লীগের। গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, বিশেষ অতিথি ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছেন।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে জানান, হেফাজতে ইসলামের অরাজনৈতিক কয়েকজন নেতাকে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে। এমনকি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও ইসলামী দলগুলোর প্রার্থীকে মাঠে রাখার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। কারণ ইসলামী দলগুলোর প্রার্থী না থাকলে তাদের ভোট বিএনপির বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শেষ বিকল্প স্বতন্ত্র প্রার্থী : বিএনপি ও অন্য দলগুলো যদি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জন করে তাহলে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন ১৪ দলের শরিকদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং বিএনপির সাবেক এমপিদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দলের সংসদ সদস্যদের নিজেদের এলাকায় একাধিক বিকল্প প্রার্থী ঠিক করে রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় এ নির্দেশনা দেন তিনি।দলের সভাপতির এমন নির্দেশনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধরেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন প্রার্থীকে অপহরণ করা হলো। তাহলে কী ফাঁকা মাঠে কেউ গোল দেবে? সে জন্য সবখানেই আমাদের বিকল্প প্রার্থী থাকবে।’আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির অনেক সংসদ সদস্য এখন দল থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকেই রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে আছেন। এসব নেতাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উৎসাহ দেবে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করা আবদুস সাত্তার স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হয়েছেন। এই ঘটনা থেকে বিএনপির সাবেক অনেক সংসদ সদস্য নির্বাচনে আসতে উৎসাহী হবেন বলে মনে করছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, যাঁরাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তাঁদের সবাইকে স্বাগত জানানো হবে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের তৎপরতা থাকবে।

নির্বাচনী সমঝোতা কি হবে? : বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী সমঝোতায় যাবে কি না তা এখনো পরিষ্কার নয়। এখন পর্যন্ত সব পরিকল্পনা বিএনপি নির্বাচনে এলে কী হবে এবং না এলে কী হবে—তার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিএনপি জোট ও এর সমমনাদের দাবি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ আগেই এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। এর বাইরে গিয়ে বিএনপিকে এনে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার কোনো ইঙ্গিত বা আলাপ আওয়ামী লীগের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি।

অবশ্য দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদীয় উপনেতা মতিয়া চৌধুরী বলেন, নির্বাচন এখনো দূরে। শেষ পর্যন্ত কী হবে তা এখনই বলা মুশকিল। সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনায়ও বদল আসতে পারে।

আরো পড়ুন: কালশী উড়ালসেতু উদ্বোধন কাল

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..