মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে বাজার তদারকির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, নীতিমালাগত সহায়তার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে হবে। সেই সঙ্গে অহেতুক যেন কেউ দাম বাড়াতে না পারে সেজন্য বাজারে কঠোর তদারকি করতে হবে। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এ নির্দেশ দেন তিনি। সেই সঙ্গে ইন্টেলিজেন্টস ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমসহ ৬টি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এছাড়া গত তিন মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন বেড়েছে। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এসব তথ্য জানান। মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। গণভবন থেকে এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।
এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম উপস্থিত ছিলেন। পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ, আইএমইডি সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহমেদসহ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা (সচিব) উপস্থিত ছিলেন।
এমএ মান্নান জানান, বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের সবাইকে সঞ্চয়ের মনোভাব তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, খাদ্যশস্য, অর্থ, বিদ্যুৎ ও পানি সব ক্ষেত্রেই সঞ্চয় করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে অপচয় রোধ করতে বলেছেন। এছাড়া খাদ্যের অভাব পূরণে উৎপাদন বাড়ানোরও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে বলেছেন, কোনো জমি যাতে অনাবাদি না থাকে। কৃষকরা সেচ, সার ও বীজ নিয়ে যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন সেজন্য ভর্তুকিসহ সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে। এছাড়া প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন সম্পর্ক দিয়ে নয়, প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প নিতে হবে। কোনো সংস্থা ঋণ দেওয়ার জন্য এলো আর আমরা বেশি টাকা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ব সেটি যেন না হয়। প্রয়োজন বুঝে এবং যে প্রকল্প থেকে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে সে প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, অক্টোবরে সাধারণত হাওড়ে বন্যা হয়। কিন্তু এখন ১১ তারিখ পেরিয়ে গেছে। আর পাঁচ দিন যদি বন্যার পানি না আসে তাহলে হাওড়ের ছেলে হিসাবে বলতে পারি বন্যা আর হবে না। হাওড়ে ধান ভালো হবে। এছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ধান ভালো হবে। সরকার বর্তমানে খাদ্যশস্য মজুদের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে আমাদের ধেয়ে আসা বিশ্ব মন্দা মোকাবিলার প্রস্তুতি আছে। ২০২৩ সালে অর্থনীতি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস তাই বলছে। আমরাও এর সঙ্গে একমত। কেননা বড় দেশগুলো যুদ্ধ করছে। আমরা ছোটরা তার দায় বহন করছি।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশের সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে একনেকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে আমরা শঙ্কার মধ্যে আছি। কিন্তু এখনো আমাদের অর্থনৈতিক সূচকগুলো ভালো অবস্থানে আছে। গত তিন মাসে দেশে রেমিট্যান্স গত অর্থবছরের তিন মাসের তুলনায় বেশি এসেছে। এছাড়া রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে ছিল ১১ শতাংশ। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমদানি কমে হয়েছে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে আমদানি বেড়েছিল ৪৫ শতাংশ। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ গত ৩ মাসে বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি পরিকল্পনামতো মুদ্রা সরবরাহ কমে হয়েছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাশ। বেসরকারি ঋণ প্রবাহ বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের ৩ মাসে ছিল ৮ শতাংশ। পরিকল্পনামতো গত ৩ মাসে সরকারি ঋণপ্রবাহ কমে হয়েছে ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। ব্রিফিংয়ে আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান জানান, চলতি অর্থবছরের তিন মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পেরেছে ২৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছর একই সময়ে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। ওই সময় খরচ হয়েছিল ১৯ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।
ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম প্রকল্প অনুমোদন : ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম স্থাপনসহ ৬ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ১৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৪ হাজার ৩৬২ কোটি ৬৩ লাখ, বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ২৬৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২ হাজার ৩৮৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ব্রিফিংয়ে বলেন, সড়কের ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। আমরা যেহেতু আইন মানি না, সেহেতু এই সিস্টেম সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পরীক্ষামূলকভাবে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত নতুন এ সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এরপর সফলতা লাভ করলে সারা দেশে মহাপ্রকল্প নেওয়া হবে। ইন্টেলিজেন্টস সিস্টেম সংক্রান্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১২২ কোটি টাকা। একনেকে অনুমোদিত অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে, সীমান্ত হোস্টেল কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ। ব্যয় হবে ৫৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এছাড়া ঘোনাপাড়া থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ লুৎফর রহমান সেতু অ্যাপ্রোচসহ সড়কাংশ যথাযথ মানে উন্নীতকরণ, ব্যয় ৩৪৭ কোটি টাকা। শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলায় পদ্মা নদীর ভাঙন রোধকল্পে নদীতীর সংরক্ষণ, ব্যয় ৫৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প, ব্যয় বেড়েছে ৫ হাজার ৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ফলে এ প্রকল্পে মূল ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
আরও পড়ুন: মধুমতী ও তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন