বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশের গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, উল্লিখিত তিন মাসে বিক্রি বাড়লেও পণ্য উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটিকে লোকসান গুনতে হয়েছে। সিঙ্গার বাংলাদেশ গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পণ্য বিক্রি করে প্রায় ৫১৮ কোটি টাকা আয় করেছে। গত বছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৪৫৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিটি সংকটের মধ্যেও গত বছরের চেয়ে ৫৯ কোটি টাকা বেশি আয় করেছে। কিন্তু পণ্য উৎপাদন খরচ, আর্থিক ও পরিচালন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি এ তিন মাসে কোনো মুনাফা করতে পারেনি। উল্টো সাড়ে আট কোটি টাকা লোকসান করেছে। অথচ আগের বছর একই সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সিঙ্গারের এক যুগের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক যুগের ব্যবধানে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এই প্রথম কোম্পানিটিকে লোকসান গুনতে হয়েছে। এক যুগের মধ্যে সিঙ্গার জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছিল ২০১৮ সালে। ওই বছর কোম্পানিটি ৪৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা করেছিল করোনায় আক্রান্ত বছর ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে। করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও সিঙ্গার ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৪৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল।
করোনার ধাক্কার মধ্যেও কোম্পানিটি মুনাফার ধারায় ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা করোনার চেয়েও বড় প্রভাব ফেলে ব্যবসা-বাণিজ্যে। ব্যবসার পরিবেশ স্বাভাবিক থাকার পরও শুধু নানা খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটি লোকসানে চলে গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে লোকসানের কারণ হিসেবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয় গত প্রান্তিকে।
পরিবহন, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে ইলেকট্রনিক সামগ্রীর বিক্রিতে। এ সময়ে মানুষ জরুরি প্রয়োজন না হলে ইলেকট্রনিক কোনো সামগ্রী কেনেনি। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় তাতে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। আবার জুলাই-সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল বেশ ঊর্ধ্বমুখী। সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম খেতে হয় সাধারণ মানুষকে। এসব কারণে ইলেকট্রনিক গৃহস্থালি সামগ্রী কেনার প্রতি মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।
টাকার মান কমায় ওয়ালটনের ২৬২ কোটি টাকা ক্ষতি
গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৪৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে ইলেকট্রনিক খাতের দেশীয় জায়ান্ট কোম্পানি ওয়ালটন। অথচ গত বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটি ২৮১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। তার আগের বছর করোনার মধ্যেও উল্লিখিত প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা ছিল ৪০২ কোটি টাকা। কোম্পানিটি গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে জানায়, গত প্রান্তিকে শুধু ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই ২৬২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে কোম্পানিটি। ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি না হলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ওয়ালটনের ২০০ কোটি টাকার মুনাফা হতো।
এদিকে কাঁচামালের দাম, পরিবহন খরচ, খুচরা যন্ত্রাংশ ও ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় উল্লিখিত সময়ে ওয়ালটনের আর্থিক ব্যয় বা খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২২ কোটি টাকার বেশি। আগের বছর একই সময়ে আর্থিক খরচের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণী আমার সংরক্ষণে রয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের পর এই প্রথম কোনো এক প্রান্তিকে ওয়ালটন লোকসান করেছে। অর্থনীতির বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকটের কারণেই এ লোকসান গুনতে হয়েছে। দ্রুত লোকসান কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় রয়েছি আমরা।’
তবে ওয়ালটন–সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, গত এক যুগেরও বেশি সময় পর এই প্রথম এক প্রান্তিকে লোকসানে পড়েছে ওয়ালটন।
ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোর্শেদ বলেন, ‘খরচ অনেক বেড়ে গেলেও এ দেশের মানুষের কথা ভেবে আমরা পণ্যের দাম খুব বেশি বাড়াইনি। এ কারণে লোকসানের ভার নিতে হয়েছে। আমরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে পেরেছি।’